কবি:- এ কে সরকার শাওন।
লেখক সমরেশ মজুমদারের একটি লিখায় নীচের চারটি লাইন (তুলশী দাসের দোঁহা) জগলুর খুব মনে ধরেছিলঃ-
“প্রথম প্রহরে সবাই জাগে,
দ্বিতীয় প্রহরে ভোগী।
তৃতীয় প্রহরে তস্কর জাগে
চতুর্থ প্রহরে যোগী।”
প্রথম ও দ্বিতীয় প্রহরের কথা না হয় বাদই দিলো। জগলু তস্কর নয় যোগীও নয় তবু মাঝে মধ্যেই রাত্রির তৃতীয় ও ৪র্থ প্রহরে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজও রাত্রির শেষ প্রহরে বিনা নোটিশে ঘুম ভেঙ্গে গেলো! শয়ন কক্ষের লাল অনুজ্জ্বল বাতিটা এবং বিদ্যুৎ খরচ কমানোর জন্য বাহিরের সব নিরাপত্তা বাতি নিভানো বিধায় রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজমান ! অনুজ্জ্বল বাতিটা নীল হলে অবশ্য জ্বালিয়ে রাখতো। কানিজের এতো বাজে পছন্দ নয়! কে যে এই লাল রংয়ের বাতি কিনেছিল! আগের দিনের কোন রাজা হলে এই ঠুনকো অপরাধে হয়তো লাল বাতি কেনার লোকটিকে শূলে চড়িয়ে বা গিলোটিনের ধারালো ব্লেডের নীচে রেখে শরীর থেকে ধড়টা আলাদা করে ফেলতো! বৈদ্যুতিক পাখাটি মনে হয় অনাদিকাল থেকে অনবরত পত পত করে ঘুরছে! কিছুটা বেল-২০৬ হেলিকপ্টার উড়ার শব্দের মত। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে পাখার পত পত আওয়াজ ছাড়া বিশ্বে আর কিছুই নাই। করতল গোল করে কান ঢাকলে যেমন শো শো শব্দ হয় তার চেয়ে বেশী! কালের অনন্ত যাত্রার মত আওয়াজ জগলুকে ভাবনার রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছে! পাখাটাকে ও ডেসকোকে খুব আপন মনে হচ্ছে! সারারাত নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেবা দিচ্ছে!
থাক, কাজ নেই ডেসকো ও পাখার প্রতি মায়া বাড়িয়ে। মায়া বড় খারাপ জিনিস। হৃদয় থেকে এই মায়া জিনিসটা যদি উপড়ে ফেলতে পারতো তাহলে জগলুর জীবনটা আরো গোছালো হতো! তবে একদিন হয়তো সে পারবে। বাবা বলেছিল যে কোন পরিবেশে সর্বোচ্চ ভাল থাকার চেষ্টা করতে। তাই সে Charles Albert Tindley এর লিখা ভজন “I’ll Overcome Some Day”, গুন গুন করে নীচুস্বরে গাইতে লাগলো!
সে অন্ধকার কক্ষ নামক প্রকোষ্ঠ থেকে বের হয়ে সামনের কক্ষে জগে রাখা পানি চিরচেনা অনেক স্মৃতি বিজড়িত একটি মগে ঢেলে তৃষ্ণা নিবারনের ব্যর্থ চেষ্টা করলো! একটু এগিয়ে দরজার সিড়িতে বসলো। সন্মুখে সবুজ উঠান, হাজার ফুলের ঘ্রাণ, লতা-পাতা-ফুল, হিমেল হাওয়া, আলো ছায়ার লুকোচুরি খেলা; সব মিলে চমৎকার পরিবেশ! মনে যা আসলো চট করে তা নিয়ে ক’টা লাইন লিখেও ফেললো!
“ঝিরঝির হিমেল বাতাসে
রাত্রি শেষের আলো-ছায়ার সনে,
কে দিয়ে গেল আলতো প্রলেপ
আমার তনু-মনে!
ধূসর কালো মেঘের ফাঁকে
একটি তারা তিমির গগনে!
মিটিমিটি হাতছানিতে নিরন্তর
ডাকছে আমায় বায়ুকোনে!
বায়ুকোনে নদীর পাড়ে
অভিমানী রাজকন্যার বাস!
হৃদি নিগড়িয়ে সে করেছে
জগলুর চরম সর্বনাশ!
চারিদিক! একদম নিরব নিস্তব্ধ! ইংরেজিতে যাকে বলে Calm. প্রবাদ বাক্যে আছে, “Calm, Quiet & Tranquil which brings serenity in mind.”
কতক্ষণ চুপ করে একাকীত্বের স্বাদ নিলো সে। ঝিঁঝি পোকার মত কিছু একটার শব্দ কানে এলো বটে কিন্তু একাকীত্বের ব্যাঘাত হলো না। একটু পরই টের পেলো একাকীত্বের সুখ হরণকারী আজন্ম গণশত্রু মশার অস্তিত্ব! পিঠের বামদিকে ও ডান বাহুতে দুইজন বিনা অনুৃমতিতে রক্ত পান করে চলেছে। মানুষের অসহায়ত্বের এর চেয়ে বড় উদাহরণ জগলুর জানা নাই! চার দেয়ালের মাঝে একটি মরা ঘাসের কণাও সে স্বয়ং সযতনে ধূলিপাত্রে ফেলতে ভুল করে না। তারপরও এদের নিত্য অত্যাচার তাকে ভাবায়! জানে অাল্লাহপাক কোন কিছুই নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি! এই চরম বিরক্তিকর মশা নিয়ে বহুবার ভেবেছে! নমরুদ হত্যাকারী এই মশার রয়েছে আধুনিক অঙ্গসজ্জা; যেমন শতাধিক চোখ , চার ডজনের মত দাঁত, তিনটি হৃদযন্ত্র একাধিক শোষক নল, এক্স রে ও রক্ত পরীক্ষার সুবিধা ইত্যাদি ইত্যাদি! ২৭০০ প্রজাতির মশার সবাই কামড়ায় না। স্ত্রী প্রজাতির মশা শুধু ডিম পাড়ার আগেই (খাবারের জন্য নয় ডিমের পরিপুষ্টির জন্য) কামড়ায়। মশা সবার রক্ত পান করে না! যার শরীরের রক্ত ভাল সেটা সে টেষ্ট করে ফলাফল পছন্দ হলে পান করে! জগলুর উপর মশার আক্রমনের তীব্রতা দেখে বুঝতে পারে তার রক্ত ভাল! বৈশ্বিক সমস্যা মহামারী করোনার প্রকোপে মানুষের মানবিকতা যখন তলানীতে তখনও কিন্তু মশাদের মশাবিকতা প্রশংসার দাবী রাখে। মশা কাউকে কামড়ানোর আগে স্থানটিকে তাদের নিজস্ব অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে অবশ করে নেয়। যাতে ব্যাথা কম অনুভুত হয়! তা না হলে প্রতি কামড়ে কামড়ে মানুষের ওরে বাবা ওরে বাবা বলে চিৎকার করা লাগতো! মনে হয় মশার জায়গায় মানুষ থাকলে অ্যানেস্থেশিয়া না দিয়ে এলোপাতাড়ি কামড়াকামড়ি করে একটা অনাসৃষ্টি করে ফেলতো!
যাই হোক মাশার কামড় খেতে নয় শেষ রাতের ও অাঁধারের সৌন্দর্য্য দেখতে বসেছিল। এবার সে চলে গেলো উঠানের কোমল ঘাসের কাছে। রাতের প্রথম প্রহরে বৃষ্টি হয়েছিল তাই একটু ভেজা ভেজা। জগলু একটি আরামদায়ক কেদারা এনে তার নীচে একটি কয়েল জ্বলিয়ে দিয়ে আরামে বসে! আহা কি আনন্দ তনু-মনে! চারপাশের নানা রঙ্গের ফুলগুলি সব ধূসররঙের হয়ে গিয়েছে। দিনের বেলায় সে গুনেছিল শুধু নাজ সার্কেলেই ২৯১ টি ফুল!
সব মিলিয়ে ফুলের সংখ্যা হাজার পার হবে! ছাত্রজীবনে ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “ফুলের ফসল” কবিতায় পড়েছিলঃ-
“জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!”
সেই থেকে ফুলের প্রতি অনড় আকর্ষণ নিরন্তর। তারপর আকাশের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা তার।
এই মুুহুর্তে আকাশে থোকা থোকা কোদালে মেঘ। ফাঁকা দুই এক জায়গায় তারা দেখা যাচ্ছে। সূর্য ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের তারার নাম প্রক্সিমা সেন্টোরাই! পৃথিবী থেকে ৪.২৫ আলোকবর্ষ দূরে। বিজ্ঞানীদের কথা অনুসারে ওটা আমাদের পৃথিবীর মত বা আমাদের পৃথিবীর ডুপ্লিকেট! আকারে কিছুটা বড় বটে! সেই সেন্টোরাই দ্বিতীয় আবাসস্থল হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে! যেদিন নিউজটি খবরের কাগজে পড়েছিল সেদিন থেকেই মনে ক্ষীণ ইচ্ছা পুষতে লাগলো সুযোগ পেলে সে সেখানে চলে যাবে। কিংবা কেপলার-১৬০ তারায় ও যাওয়া যেতে পারে!
যদিও তার জানা আছে “নো রিটার্ন ওয়ে!” ফেরার পথ নাই!
এস ইসলাম/
Leave a Reply