ইখতিয়ার হোসেন সরুলিয়া,(পাটকেলঘাটা, সাতক্ষীরা): যুদ্ধের পর সাতচল্লিশ বছর কেটে গেছে। আমিও এখন জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে অষ্টাশির কোঠায় পা রাখতে চলেছি। এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় জীবনে কত ঘটনার সমাবেশ ঘটেছে যার অনেকটাই হয়ত ভুলে গেছি। জীবনের কত চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনা,সফলতা-ব্যর্থতা একসময় যে সবের হিসাব নিয়ে দিন রাত মগ্ন থাকতাম সেসবের কিছু আজ পুরো ব্ল্যাকআউট, কিছু বা ঝাপসা টুকরো টুকরো ছবির মত মনে ভাসে।
এমন কি মানুষের মনের প্রিয়জন হারানোর শোকযন্ত্রণার তীব্রতাও তো সময়ের প্রলেপে ফিকে হয়ে যায়। তবে এটাও সত্য যে মানুষের জীবনে কোন কোন ঘটনা সময়কে অস্বীকার করে স্মরনের পাতায় চিরস্থায়ী হয়ে যায়। আমার জীবনেও এমনই এক ঘটনার স্মৃতি সাতচল্লিশ বছর ধরে এক অবিচল সত্য হয়ে মনে জেগে আছে ।বয়সের জড়তাকে উপেক্ষা করে আজ সেই শোকাবহ অথচ গভীর অর্থবোধক ঘটনার বয়ান লিখতে বসেছি, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে আরো অসংখ্য ঘটনার মতই উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।
এ এক মর্মান্তিক ঘটনার কাহিনি যা ঘটেছিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র দশদিন পরে ৫ এপ্রিলে। ঐ দিন যশোর শহরে পাকিস্তান আর্মিরা আমার স্বামী ডাঃ ওবায়দুল হককে গুলি করে হত্যা করে।
সেই সময়ে আমাদের দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে আমরা যশোরে এম এম রোডের বাড়িতে বাস করছিলাম। আমরা যশোরের পুরানো বাসিন্দা। আমার স্বামীর দেশ খুলনায়, শিক্ষাবিদ পিতার কর্মস্থল চট্টগ্রাম শহরে তাঁর জন্ম হয়। আমার দেশ যশোর, শিক্ষাবিদ আব্বার কর্মস্থল কলকাতায আমি জন্ম গ্রহণ করি।বিয়েরন পর আমার স্বামী ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাজে ইস্তফা দিয়ে যশোরে এসে প্রাকটিস শুরুকরেন।আমি যশোর সরকারি গার্লস স্কুলে চাকরি করতে শুরু করলাম। ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখেই বাস করছিলাম আমরা ।
ওবায়েদের একচল্লিশ বছরের জীবনটা ছিল একটা সরল রেখার মতোই স্বচ্ছ ও নির্মল। ভাল ডাক্তার ছিলেন। নানা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। দেশকে ভালবাসতেন। দেশের উন্নতির দিকে তাঁর লক্ষ্য ছিল, তবে কোন রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। বাঙালি বুদ্ধিজীবি হিসেবেই পাক সেনারা তাঁকে হত্যা করেছিল।
একাত্তরের মার্চ মাসের শেষ দিকের দিনগুলো ছিল বড় দুর্বহ। আশা ও আশঙ্কার দোলাচলে মানুষ দুশ্চিন্তায দিন কাটাচ্ছিল। আসলে পাকসরকারের নীতি হীন কারসাজি ও বর্বরতা সম্বন্ধে মানুষের কোন ধারণাই ছিল না। রাজনীতির গতি কোনদিকে যাচ্ছে তা বুঝতে না পেরে দেশের মানুষ ক্রমে দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। আমি নিজেও তখন যেন এক অনিশ্চিত বাতাবর্তের ঘোরে ছিলাম।
২৫ মার্চ আমরা যশোরেই ছিলাম। সেই ভয়ঙ্কর রাতে ঢাকার পৈশাচিক তান্ডব লীলার খবর আমরা কিছু জানতাম না। সে রাতে ফোনে ঢাকায় কারোর সংগে যোগাযোগ করতে না পেরে খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়েই ঘুমাতে গেলাম। ঘুম হলো না তেমন। শেষ রাতে যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে আসা গোলাগুলির আওয়াজে আমরা সকলে জেগে উঠলাম। ওবায়েদ ফোন তুলতে গিয়ে দেখলেন ফোন বন্ধ। টিভি রেডিও সব বন্ধ, সংযোগ নেই।
একটু পরেই ভোর হয়ে গেল। বাইরে কারফিউ। রাস্তাঘাট নিস্তব্ধ, জনহীন। মাঝে মাঝে আর্মির গাড়ি যাচ্ছে। কোথায় কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। নিরুপায় অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে দিনটা শেষ হয়ে গেল। পরদিন ২৭ মার্চ সকালে দু ঘন্টার জন্য কারফিউ উঠে গেল। দু চার জন দেখা করতে এল। তাদের মুখে ঢাকার বিভীষিকার খবর শুনলাম। আতঙ্কিত আরেকটি দিন কাটল।
২৮ তারিখে খুব ভোরে আমাদের বাড়ির সামনে আর্মি একজনকে গুলি করে মেরে ফেললো ।রাস্তার শেষ প্রান্তে শ্রমিকদের একটা চালাঘর ছিল, কোন এক হতভাগ্য বুঝি না জেনে বাইরে বের হয়েছিল, প্রানটা গেল।সকালের আলোয় দেখলাম কেউ কোথাও নেই, শুধু চাপ চাপ রক্ত বালি দিয়ে ঢাকা।আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। ওবায়েদ বললেন, মনে হচ্ছে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। কাল দুপুরে দেখি পাকিস্তান স্টোরের ছেলেরা কারফিউয়ের মধ্যে বের হয়ে সিপাহিদের সংগে হাসি তামাশা করছে। এরা কখন কি করে বোঝা যাচ্ছে না। রাতে এখানে থাকা ঠিক হবে না। আমরা বরং গ্রামে মামার বাড়িতে কয়েকদিন ঘুরে আসি।তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলি।
আমাদের কিন্তু শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়া হল না। রাস্তায় রাস্তায় পাকসেনারা পাহারা দিচ্ছে ।শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। ওরা বলল, ডরনেকা কোই বাত নেই।ঘরমে যাকে আরাম কিজিয়ে। বাধ্য হয়ে ফিরে আসছিলাম। পথে পড়ল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট । প্রিন্সিপাল সুলতান আহমদ ছিলেন আমাদের বন্ধু মানুষ।ওবায়েদ নিজেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সুলতান সাহেবের বাসায় যাবে? প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। বাড়ি ফিরতে একটুও ইচ্ছা হচ্ছিল না । সামনের পাকিস্তান স্টোরের দোতলায় বিহারি ছেলেদের রাতে আড্ডার কথা ভেবে ভয় করছিল। পাঁচিল ঘেরা সরকারি বিরাট ক্যাম্পাস দেখে মনে ভরসা পাচ্ছিলাম বোধহয় । ভেবে চিন্তে ওখানেই গেলাম আমরা। দারোয়ান এসে গেট খুলে দিল। আমরা ভিতরে ঢুকলাম। এইভাবে আমার স্বামীর অন্তিম স্হানে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেরাই পৌঁছে গেলাম।একেই বোধহয় বলে নিয়তি।
সুলতান আহমদের দেশ কুমিল্লায। ইংল্যান্ড থেকে সদ্য ফিরে কয়েক মাস আগে প্রিন্সিপাল পদে জয়েন করেছেন। সুলতানও খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন ।আমাদের পেয়ে খুশি হয়ে উঠলেন। তাঁর প্রেগন্যান্ট তরুনী স্ত্রী, শালা ও ভাই ছিল বাংলোয়। আমরা ৫ তারিখ পর্যন্ত ওদের সঙ্গেই ছিলাম ।
ওবায়দুল হক ও সুলতান আহমেদ দুজনেই ছিলেন নির্বিরোধী বুদ্ধিজীবি নাগরিক।গনহত্যার প্রথম পর্যায়ে তাঁরা কেউই পাকসেনাদের ক্রুর নৃশংসতার সঠিক পরিমাপটি উপলব্ধি করতে পারেন নি।ওরা যে তাঁদের হত্যা করবে তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন নি।এপ্রিলের প্রথম দিকে শহর ছেড়ে যাওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর বাঙালি সিপাহিরা আত্মরক্ষার জন্য তিন দিন ধরে পাকসেনাদের ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। সেই সুযোগে অনেকে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল । আসলে পলিটেকনিক কলেজটা শহরের একপাশে থাকায় শহরের সঠিক খবর জানা যাচ্ছিল না। সুলতান আহমেদ প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিয়ে ছাত্র ও স্টাফদের ক্যাম্পাস না ছাড়তে উপদেশ দিলেন। প্রথম দু একদিন তাঁর কথা মেনে নিলেও পরে আস্তে আস্তে প্রায় সকলেই কলেজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সুলতান সাহেব আমাদের থাকতে বললেন। ভবিতব্যের ইশারায় আমরাও দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে থেকে গেলাম । ৩ তারিখ থেকে বিদ্যুৎও পানি বন্ধ হয়ে গেল। শোনা গেল ইপিআর বাহিনী পিছু হটছে। ৪ এপ্রিল সন্ধ্যার সময় অন্ধকার বারান্দায় সকলে নীরবে বসে ছিলাম । এমন সময় দূরের বিহারি কলোনি থেকে আজানের ধ্বনি ও উল্লাসের হৈ চৈ রব ভেসে এলো। আমরা কজন প্রানী কাঠ হয়ে বসে রইলাম। একটু পরে ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো।
পরদিন ৫ এপ্রিলের সকাল। দরজা বন্ধ করে নীরবে কাজকর্ম করছি সবাই। কোন রকমে একটা ডিমের ঝোল রান্না করা হলো। কারোর অবশ্য খাওয়া হয় নি সেই ডিমের ঝোল।
ওরা এলো ৫ এপ্রিলের দুপুর দুটোয। সাতজন সশস্ত্র আর্মি দরজায় এসে দমদম ধাক্কা দিতে শুরু করল । সুলতান সাহেব গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। তাঁর ধারণা ছিল সরকারি চাকুরীজীবি হিসাবে পরিচয় দিলে আর কোন সমস্যা হবে না। দরজা খুলতেই এক সিপাহি তাঁর গালে চড় বসিয়ে দিল। উনি বলতে গেলেন আমি মাষ্টার, আমি মাষ্টার। কিন্ত ওরা এক হেঁচকায় তাঁকে পোর্টিকোয় নামিয়ে গুলি করে মেরে ফেললো। ইতিমধ্যে আমার স্বামীও বের হয়ে এসেছিলেন। দরজার কাছে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বাইরে যাচ্ছি, সুলতান একা আছেন।
ওদের মধ্যে একজন অফিসারও ছিল। ওবায়েদের নাম বা পরিচয় ওরা কিছুই জিজ্ঞাসা করে নি। একটা প্রশ্নই তারা করেছিল তোমাদের জবান কি? উর্দু না বাংলা? আমার স্বামী নির্ভয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, আমি বাঙালি। ওরা বলল, মরনের জন্য তৈরি হও। ওদের জবানটা অবশ্যই ছিল
উর্দুতে। এরমধ্যে বাড়ির ভিতর থেকে পরিবারের সকলকে ওরা হাত ওঠাতে আদেশ দিয়ে বারান্দায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আমার পাঁচ বছরের শিশুপুত্রকেও ওরা হাত ওঠাতে বাধ্য করেছিল।
ওবায়েদ, সুলতান সাহেবের ভাই ও শালাকে ওরা পোর্টিকোয় সারি দিয়ে দাঁড় করালো। সিপাহিরা উম্মাদের মত বার বার বলছিল, হাত উঠাও, হাত উঠাও। এক পর্যায়ে আমার স্বামী উর্দুতে বললেন, হাত তো উঠিয়েছি আর কি করবো? তাঁর বিশুদ্ধ উর্দু শুনে অফিসারটা নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপ বিহারি হ্যায়? নির্দোষ মানুষ মৃত্যুকালে নির্ভয় হয়। আমার স্বামী ভয়হীন স্বরে উত্তর দিলেন, না। আমি বাঙ্গালী। এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা।
কমান্ডার অর্ডার দিল ফায়ার করার। ওবায়েদ চারদিক একবার তাকিয়ে নিলেন। আমাদের দিকেও তাকালেন। তারপর আস্তে আস্তে কলেমা পড়লেন। বাকি দুজনও কলেমা পড়ল।
বন্দুকের গুলির শব্দ। তিনজনের কেউই আর দাঁড়িয়ে নেই। ওবায়েদ আস্তে ঘুরে মাটিতে পড়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে রইলেন। ছটফট করেন নি একটুও। রক্তের ছাপ দেখা যায় নি কোথাও। বর্বর মূর্খ পাকিস্তানীদের অত্যাচারে দুইজন ভাল ও সৎ মানুষ অকারণে প্রান হারিয়ে নিশ্চুপ হয়ে মাটিতে শুয়ে রইলেন। তাঁদের মৃত্যুর কারন ছিল একটাই — তাঁরা বাঙালি,বাংলা তাঁদের ভাষা।
এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। পাকসেনারা আর বেশিক্ষণ দাঁড়ায় নি। জলদি কর, জলদি কর, আরো খতম করতে হবে এই কথাটাই ওরা বার বার বলছিল।একজনকে ওরা পাঠাল ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। সে টেবিলের উপর রাখা ঘড়ি, টাকা পয়সা চুরি করতে ব্যস্ত ছিল। বাইরে বাকিরা অপেক্ষা করছিল। দেরী দেখে আমিই বললাম, আমাদের গুলি কর। আমার শিশুপুত্র কেঁদে বলল না না, ওকথা বোল না আম্মা ওরা তাহলে আমাদের মেরে ফেলবে।
অফিসারটা উত্তর দিল, না, আমরা পুরুষদের মেরে ফেলেছি, ঘরে আগুন লাগিয়েছি, এখন তোমরা যেখানে ইচ্ছা চলে যাও। সকলে একসঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে চলেছি ভেবে এতক্ষণ আমি যেন এক অদ্ভুত নির্ভার অবস্থায় ছিলাম। আমরা বেঁচে থাকছি, মরছি না এই তথ্যটি বোধগম্য হওয়া মাত্র পৃথিবীটা যেন দুঃখের বোঝা নিয়ে চারদিক থেকে আমাকে চেপে ধরলো। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমার স্বামী আর নেই, তাঁর সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না এতক্ষণে সেটা অনুভব করে আমার বুকটা যেন চৌচির হয়ে যেতে লাগল।
সুলতান সাহেবের তরুনী স্ত্রী কেঁদে বলল,আমরা তবে কি করব? কোথায় যাব?
একজন মূর্খ হা হা করে হেসে উপহাস করল, উও মুজিবর রহমান সে পুছো। আমার ষোল বছরের মেয়ে শীরীন ক্রোধ চাপা স্বরে বলল, কুকুরের বাচ্চা তোরা। সে কথা শুনে ফেলে একজন বেয়নেট উঁচু করে ধরল শীরীনের দিকে। আমি শীরীনকে একটা চড় মেরে ধমক দিয়ে চুপ করতে বললাম। ভাগ্য ভাল, সিপাহিটা বেয়নেট নামিয়ে চলে গেল। তারপর ওরা রাইফেল উচিয়ে অন্যদিকে ছুটে চলল আরো বাঙালিকে হত্যা করার নেশায়।
ওরা চলে যাওয়া মাত্র আমরা সকলে পোর্টিকোর দিকে দৌড়ে গেলাম। সুলতান সাহেব ও ওবায়েদ অবশ্য আগেই চলে গিয়েছিলেন। আল্লাহর কি রহস্য। সুলতান আহমদের ভাই অক্ষত দেহে বেঁচে ছিল। তার গায়ে গুলি লাগে নি। সে মৃতের ভান করে মাটিতে পড়ে ছিল। সুলতান সাহেবের একুশ বছরের তরুণ শালার কনুই ও হাটুতে গুলি লেগে অঝোরে রক্ত পড়ছিল।। যন্ত্রণায় ছটফট করছিল ছেলেটি। তাকে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলে দেখতে দেখতে বিছানা রক্তে ভিজে গেল। অনেক কষ্ট পেয়ে সন্ধ্যার সময় সে মারা যায়। ওদের তিনজনের দাফনের কোন ব্যবস্থা করা যায় নি। রাতের অন্ধকারে স্টাফ কোয়ার্টারে লুকিয়ে থাকা এক পরিবারের সংগে পলিটেকনিকের দেওয়াল টপকে,। চষা ক্ষেত্ পার হয়ে শহর থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম আমরা। হাইওয়ে দিয়ে হাটতে হাটতে দেখতে পেয়েছিলাম আগুনের শিখায় আকাশ লাল হয়ে আছে। মিলিটারিদের আগুনে যশোর শহর পুড়ছিল। মূহুর্মুহ গুলির শব্দ হচ্ছিল । সেদিন যারা শহরে ছিল তারা কেউই বাঁচে নি আর।
শোক নিয়ে বসে থাকা যায় না। দুনিয়া তো নিজের নিয়মে চলে। জীবনের দেনা-পাওনার চাহিদাগুলো সব সময়ই বর্শার ফলক উচিঁয়ে রাখে । তাই কোনমতে গতানুগতিক কর্তব্যকর্ম সেরে উট পাখির বালিতে মুখ গুঁজে থাকার মত করে একটেরে দিন কাটাতাম। নয়মাসের মধ্যে কত বীভৎস ঘটনা ঘটে গেল। কত রক্ত, হত্যা, নৃশংসতা, হনন, হরণ, নিস্পৃহ উদাসীনতায় দেখে গেলাম।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর এল মুক্তির আলো নিয়ে। আমি তখন ঢাকায়। কারফিউ অগ্রাহ্য করে অনেকে এলো দেখা করতে। সারা দিন মানুষের আনাগোনা চলল। সকলের মুখেই হাসি।পাকিস্তানিরা সারেন্ডার করতে যাচ্ছে।আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম হাসিমুখে। অন্তরের বেদনাকে প্রকাশ করে অন্যদের দুর্লভ আনন্দ উপভোগে বিঘ্ন ঘটাতে চাই নি।
কিন্ত মনের আবেগের প্রকাশ সব সময় মানুষের হাতে থাকে না। মানুষ যখন একলা থাকে তখনই তার খোলস খুলে পড়ে। সেই রাতে সকলে চলে গেলে আমি বিছানায় এসে নিজেকে সংযত রাখতে পারি নি। ভেঙ্গে পড়েছিলাম অঝোর কান্নায় ।প্রানফাটা মর্মান্তিক বেদনা বোধে আমার হৃদয় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। বিছানা উলটপালট করে, চাদর হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরে আমি কাঁদছিলাম। আমি কেঁদেই যাচ্ছিলাম। এই নয়মাসের মধ্যে আমার শোকের প্রকাশ এমন লাগাম ছাড়া কখনো হয় নি ঘুমএলেওবার বার চমকে জেগে উঠছিলাম। মস্তিষ্কের কোষে কোষে উত্তেজনা যেন বিষ্ফোরনে ফেটে পড়ছিল।এই ভাবে তন্দ্রা ও জাগরনের ঘোরে দীর্ঘ যন্ত্রণাময় সময় পার করে দিয়ে অবশেষে গভীর রাতে আস্তে আস্তে
কেমন করে যেন মনের ঝড় প্রশমিত হতে শুরু করল। মাথা হালকা হয়ে এলো। চোখ ভরে ঘুম এলো ঘুমের ঘোরে এলোমেলো স্বপ্ন দেখছিলাম।শেষের স্বপ্নটায় দেখলাম শাদা কুয়াশা ঢাকা বিশাল প্রান্তরে লাখ লাখ লাশ, কবরহীন, আকাশ ফাটা করুন আর্তনাদ, বাংলার মা, বোন, স্ত্রীর আহাজারি আর হাহাকার। যদিও স্বপ্নটা খুব স্পষ্ট ছিল না কিন্ত স্বপ্নের এফেক্টটা ছিল দিনের আলোর মত পরিষ্কার যা এতকাল পরেও মনে বাস্তবের মত জীবন্ত হয়ে আছে। বিছানায় উঠে বসলাম। ভোর হয়ে আসছে। গভীর বিস্ময়ে দেখলাম আমার মন এখন ধীর,সুস্হির। রাতের ক্ষোভ দুঃখের কোন চিহ্নই নেই আর। বরং করুনা ও ব্যথা মিশ্রিত বর্ননাতীত এক আশ্চর্য উপলব্ধিতে মন অভিভূত হয়ে আছে। হৃদয় গলানো সহমর্মিতার প্রপাতধারায় ভেসে গিয়ে যেন মিশে যাচ্ছিলাম বিশ্বময় মানববেদনার স্রোতের ধারায় । জীবন যখন শুকায়ে যায় করুনা ধারায় এসো। করুনাময় এই প্রার্থনা তো হেলা করেন না কখনো। মনের মধ্যে এসব ভাবনা তো তৈরি হয়েই থাকে যা কিনা সুযোগ পেলে বের হয়ে আসে পাথর ফেটে পানির ধারা বহানোর মত। শোকের মধ্যেই থাকে শক্তি, দুঃখের মধ্যেই থাকে প্রাপ্তির সম্ভাবনা। ১৬ ডিসেম্বরের রাত এই চেতনা জাগরনে নয় ঘুমের মধ্যে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ভরে দিয়ে গেল। একটু পরেই ভোর হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল চারদিকে।
পরের বছর আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে কানাডায় চলে আসি।এখন ওরা নিজ নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সুশীল ও সুমিত জীবন যাপন করছে। নাতিনাতনী নিয়ে আমার পরিপাটি পরিবেশ। আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যখন পিছনে তাকাই তখন দেখি সেদিনের সেই শূন্যতার হাহাকারের বিস্তার আজ অলৌকিক মায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে। আমাকে বন্চিত ও দুঃখী হয়ে জীবন কাটাতে হয় নি কখনো। বাংলাদেশ থেকে দূরে থেকেও দৈবিদ্ধ মানসিকতায় আমার আস্থা নেই। এদেশের মধ্যেই বাংলাদেশকে খুঁজে নিতে কষ্ট হয় নি আমার। দেশে যাই। মানুষের অবিচার, নিরুপায়তা, বিবেকহীনতা চোখে পড়ে, কিন্তু আশা হীন হই না কখনো। কারণ আমি জানি ওবায়েদের মতোই বাংলাদেশে ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা নির্ভীক বলিষ্ঠতায় ঘোষণা করতে পারে আপন সত্তার অকপট প্রকাশ, যেমন করে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে ওবায়েদ ভয়হীন কন্ঠে ঘোষণা করেছিল আমি বাঙালি। ১৬ ডিসেম্বর রাতে অর্জিত চেতনাবল নিয়ে আমিও সেইসব ভয়হীন মানুষের মধ্যেই বিচরণ করি। পরিবার, স্বজন, বন্ধু ও জীবনের পথে দেখা হওয়া কত মানুষের বিশ্বাস মায়া, ভালবাসা ও মমতার দাক্ষিণ্যে সমৃদ্ধ থাকি। ।লোকাতীত অনুভবের আভাসে মন আপ্লুত হয়ে ওঠে । আমি অভিভূত হয়ে থাকি। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় প্রনত হই। এইভাবে রিক্ত ও বিষাদিত হয়েও এক মধুর প্রসন্নতায় আমার শেষের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে।
বি:দ্র: লেখাটা আমাদের হাতে আসে ১৪/৬/১৮ তারিখে।লেখিকা বর্তমানে কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা। আর এই ৯০বছরের প্রবীণা,বয়সভারে ক্লান্ত শহীদজায়ার আরো একবার সরুলিয়া আসার ইচ্ছে প্রবল।
এস ইসলাম/
Leave a Reply